আবদুর রউফ সমাজ, রাজনীতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্য–সচেতন মানুষ। তাঁর জন্ম ১৯৩৩ সালের ১১ নভেম্বর কিশোরগঞ্জ জেলার ভৈরব উপজেলায়। তাঁর পিতা আবদুল লতিফ ভৈরব পৌরসভার প্রথম এবং একটানা চৌদ্দ বছর পৌর–চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন আবদুর রউফ। ভাষা–আন্দোলনে ছিলো তাঁর সক্রিয় অংশগ্রহণ। তিনি তৎকালীন ঢাকা কলেজ ছাত্র–সংসদের নির্বাচিত ক্রিড়া সম্পাদক ছিলেন। এছাড়া তিনি কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ ছাত্র–সংসদ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হল ছাত্র–সংসদের ছিলেন নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক ।
১৯৬২ সালে তিনি পাকিস্তান নৌবাহিনীতে যোগ দেওয়ার পর বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের সাথে যুক্ত হন। ১৯৬৮ সালে দায়ের করা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম অভিযুক্ত ছিলেন তিনি। এই সংগ্রামে সক্রিয় থাকায় আগরতলা মামলার আসামী হিসেবে তাঁকেও আটক করা হয়। পরবর্তী পর্যায়ে ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের ফলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবসহ অন্য অভিযুক্তদের সঙ্গে কারামুক্ত হন।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়ন পরিচালিত যৌথ গেরিলা বাহিনীর অন্যতম পরিচালক হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে দায়িত্ব পালন করেন।
স্বাধীনতার পর স্বল্প সময়ের জন্য তিনি ন্যাপের অন্যতম সম্পাদক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭২ সালের শেষ দিকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে পুনরায় নৌবাহিনীতে যোগদান করেন। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়ার পর তাঁকে গ্রেফতার করা হয় এবং নৌবাহিনী থেকে অপসারণ করা হয়।
ঢাকা শাহীন স্কুল ও কলেজের প্রতিষ্ঠাতা উপাধ্যক্ষ হিসাবে তিনি কিছুদিন দায়িত্বরত ছিলেন। ভিন্ন ভিন্ন সময়ে তিনি নরসিংদি কলেজ ও চট্টগ্রাম রাঙ্গুনিয়া কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৭৮ সালে তিনি একটি বেসরকারী সেবা–প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। যার মূল কাজ ছিলো, সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে স্বাস্থ্য–সেবা প্রদানের মাধ্যমে তাদের জীবন–মানের উন্নয়ন ঘটানো।
১৯৯৩ সালে তিনি গণফোরামের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করেন।
২০০৪ সালে সকল কর্মকাণ্ড থেকে অবসর গ্রহণ করে তিনি লেখালিখি ও সামাজিক কার্যক্রমের সাথে সংশ্লিষ্ট হয়ে পড়েন। তাঁর লিখিত কয়েকটি বই হলো–
১.আগরতলা মামলা ও আমার নাবিক জীবন;
২.আমার ছেলেবেলা ও ছাত্র–রাজনীতি;
৩.বন থেকে বন্দরে;
৪.যুগসন্ধির সুরধ্বনি;
৫.মুক্তিস্নান;
৬.কর্বটকন্যা; এবং
৭.মাতঙ্গীদেবী উপাখ্যান।
তাঁর ওপর অন্যদের লিখিত কয়েকটি বই হলো–
১.সন্মাননা স্মারক (মৃত্যুর আগে বের হয়েছে);
২.কমান্ডার আবদুর রউফ স্মরণপত্র (মৃত্যুর পরে বের হয়েছে);
৩.আমার বাবা কমান্ডার আবদুর রউফ, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা এবং তারপর।(এ বইটি তাঁর ছোট মেয়ে কথাসাহিত্যিক গীতালি হাসানের লেখা)।
২০১২ সালে বাংলা একাডেমি তাঁকে সম্মানসূচক ফেলোশিপ প্রদান করে। মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার ২০২০ সালে তাঁকে মরণোত্তর স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করে।
এই জনপদের মানুষের মুক্তিকাক্ষায় কমান্ডার আবদুর রউফ ছিলেন নিয়ত চিন্তাশীল ও সংগ্রামশীল ।
২০১৫ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে কর্মবীর এই মানুষটি পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চিরবিদায় নেন।
_ _ _